আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। এটি বাংলাদেশের সীমানা ঘেঁষে অবস্থিত। এই ভারতে ইউরোপিয়ানরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করেছিল। মধ্য যুগে আরবদের সঙ্গে ইতালির বিভিন্ন শহরের প্রচুর বাণিজ্যিক লেনদেন হয়।
আরব বণিক রা ভারত ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে মণিমুক্তা রেশম ও নানা সুগন্ধি মসলা সংগ্রহ করে ভুমধ্যসাগরের বন্দরগুলোতে নিয়ে আসতোএবং ইতালির বণিকরা এই পণ্যগুলি ইউরোপের বাজারে বিক্রি করে অনেক লাভ করত।
পরবর্তীতে তুর্কিদের হাতে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য পতন ঘটলে প্রাচ্য দেশগুলিতে যাতায়াতের একমাত্র স্থলপথে ইউরোপিয়ানদের কাছে বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা প্রাচ্য যাওয়ার জন্য নতুন নতুন জলপথে সন্ধানে বের হয়।
মার্কোপোলোর ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইউরোপের মনে প্রাচ্যের দেশ গুলি সম্পর্কে কৌতূহল ও বৃদ্ধি করে।
সর্বোপরি এই সময়ে নবজাগরণ দেখা দিলে দু সাহসিক মানুষের মনে অজানাকে জানার ও নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করার আগ্রহ দেখা যায়।
এই সময়ে ইউরোপিয়ানরা মূলত ভারতে এসেছিল বাণিজ্য করতে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল প্রচুর পরিমাণে লাভ করে দেশে ফিরে যাওয়া। নক্ষত্র পরিমাপক যন্ত্র বিষুব রেখা ও অক্ষরেখার নিরূপণ করার উপযোগী যন্ত্রের আবিষ্কার এবং নানা ধরনের মানচিত্র ও তালিকা প্রস্তুত করা হলে সমুদ্রপথে দেশ ও মহাদেশ আবিষ্কার এর কাজ সহজ হয়নতুন জলপথ ও নতুন জগৎ আবিষ্কার এর ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল পর্তুগিজ নাবিক।
এই প্রসঙ্গে পর্তুগালের যুবরাজ হেনরির নাম উল্লেখযোগ্য। তার অত্যন্ত দৃঢ় সাহস এবং প্রচেষ্টায় বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও দিক নির্ণয় করার যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়।
নাবিক হেনরি মৃত্যুর প্রায় ২৫ বছর পর অন্য এক পর্তুগিজ নাবিক বিষুব রেখা অতিক্রম করে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল দিয়ে ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হন। আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্তে এক প্রবল ঝড়ের সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে এবং এই কারণে তিনি আফ্রিকার শেষ প্রান্তের নামকরণ করেন ঝরের অন্তরীপ। দ্বিতীয় জনের মনে এই বিশ্বাস জন্মায় যে আফ্রিকা দক্ষিণ উপকূলের পথ বেয়ে প্রাচ্যের দেশগুলোতে পৌঁছানো সম্ভব এবং এই কারণে তিনি এই অন্তরীপ এর নামকরণ করেন উত্তমাশা অন্তরীপ।
গোবিন্দা ও ভৌগোলিক আবিষ্কারের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য যুবরাজ হেনরির ইতিহাসে নাবিক হেনরি নামে তিনি পরিচিত। হিন্দি প্রচেষ্টায় সাগর মহাসাগর এর বহু অজানা মানচিত্র উদঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে ইউরোপ থেকে সরাসরি ভারতে আসার জলপথ আবিষ্কার এর কর্তৃত্ব হলো অপর এক পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দা গামা।তিনি পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে ভারতের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হন।
কালিকট বন্দরে পৌঁছানোর পর তিন মাস সেখানে অবস্থান করেন এবং ১৪৯৯ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
অন্যান্য অনেক মূল্যবান দ্রব্যাদি সঙ্গে নিয়ে যান।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন ও বৃটিশ আমল
একসময় পৃথিবীতে ব্রিটিশদের সূর্য কখনো অস্তমিত হতোনা। পন্ডিতের মতে একসময় পুরো পৃথিবী ব্যাপী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা ছিল। তেমনি ভারত বর্ষ এর ব্যাতিক্রম হয়নি। ২০০ বছর ভারতবর্ষে তাদের আধিপত্য বজায় ছিল।
পলাশীর যুদ্ধের পরে ১০০ বছর ব্যাপী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের পর সিপাহী বিদ্রোহের দুজন মহারানী ভিক্টোরিয়ার রাজকীয় ঘোষণার ফলে একদিকে যেমন উপমহাদেশে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল অন্যদিকে তেমনি নানা ঘটনার চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ভারত স্বাধীনতা আইন ও মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশ বিভক্ত হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করে।
কিন্তু ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হলেও পূর্ব বাংলার মানুষ আবার নব্য উপনিবেশিক পাকিস্তানের শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয় টানা ২৪ বছর। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নের বিয়ের বাঙালিরা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার মর্যাদা বজায় রাখে। অর্জিত হয় বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আর এই ভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটায় যা স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষের কার্তিকের আর আরেকটি বিষয় বড় করে দেখাতে চান ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষকে এক শাসনের অধীনে নিয়ে এসেছিল। তাদের ব্যাখ্যা হলো ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার আজ পর্যন্ত ভারতে একগুচ্ছ রাজত্ব ছিল এবং ব্রিটিশ শাসনে ভারতকে একত্র করে। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্চিল এমন মন্তব্য করেছিলেন যে ব্রিটিশরা আসার আগ পর্যন্ত কোন ভারতীয় জাতীয় চিলো না অর্থাৎ ভারত ছিল একটি ভৌগলিক ধারণা।
ওই সময় থেকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আসতে শুরু করে মুসলিম আরব ব্যবসায়ীরা। হাজার ৯০০ থেকে ইরানের বাহাইদের ওপর নির্যাতন শুরু হলে এই সম্প্রদায়ের লোকজন আসে আর যখন পলাশীর যুদ্ধ হয় সেই সময়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীগণ অন্যান্য পেশাজীবী গঙ্গা অববাহিকা কাছে বসতি গেরেছিলেন।ভারতের একত্রীকরণের ব্রিটিশরাজের ভূমিকা সম্পূর্ণ সঠিক। এভাবে দেখলে ভারতের ইতিহাস প্রকৃত সত্যের বিপক্ষে যাবে।হাজার বছর ধরে এখানকার বড় বড় শাসক তাদের সাম্রাজ্যকে ভারত বর্ষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে এসেছে।
খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে কে উচ্চাভিলাষী ও প্রভাবশালী সম্রাটেরা যতক্ষণ পর্যন্ত পুরো দেশ তাদের অধীনে না আসছিল ততক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের শাসনকে পূর্ণাঙ্গ মনে করতেন না। গুপ্ত সম্রাট অশোক মৌর্য মুঘল সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজী সহ অন্যান্যদের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাই আমাদের এই ভ্রান্ত ধারণা করা উচিত হবে না যে আঠারো শতকের মধ্যভাগে ভারত যে বিভক্ত শাসনব্যবস্থায় দেখা যায় তা ব্রিটিশরা এসে এক করার আগ পর্যন্ত ইতিহাস জুড়েই ছিল। পলাশীর যুদ্ধের খুব অল্পসময়ের মধ্যে বাংলার অর্থনৈতিক রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নবাবদের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুধু রাজি নয় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বাংলায় বিনাশুল্কে বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ পায়।এর বাইরে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও নিয়মিত তারা কথিত উপঢৌকন পেতে থাকে।ভারত থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চিত্র উঠে আসে ইতিহাসবিদ উইলিয়াম দালরিম্প্লে পর্যালোচনায়।তিনি লিখেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন গড়ে তোলা হয় তখন বিশ্ব জিডিপিতে বৃটেনের অবদান ছিল ১ দশমিক 8 শতাংশ।
আর ভারতের ২২.৫% অর্থাৎ যখন ব্রিটিশরাজের শাসন চূড়ায় তখন চিত্র উল্টো। ভারত তখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উৎপাদনকারী দেশ থেকে দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বাংলা থেকে লুট করা অর্থ ব্রিটেনে চলে যেত এবং এর সুবিধাভোগী ছিল বৃটেনের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃত্ব।পলাশী যুদ্ধের পর দেখা গেল ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শেয়ারে কিনেছেন।
অর্থাৎ উপনিবেশিক শাসনের প্রচুর পরিমাণে অর্থ বাংলা থেকে লুট হয়। ব্রিটিশ শাসকরা বাংলার প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নিয়ে নিজেদের সমৃদ্ধি অর্জন করে। তবে শোনা যায় পরবর্তীতে শীঘ্রই এর অবসান হয়েছিল।ভারতীয়দের তীব্র প্রতিবাদে উপনিবেশিক শাসকেরা নিজেদের শাসন তুলে নিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র এর আভির্ভাব ও ইংরেজ হাটাও আন্দোলন
সুভাষচন্দ্র বসু নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত।ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক চিরস্মরণীয় কিংবদন্তী নেতা হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি এক উজ্জ্বল ও মহান চরিত্র যিনি এই সংগ্রামে নিজের সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছেন। ২০২১ সালে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার জন্মবার্ষিকীতে জাতীয় পরাক্রম দিবস বলে ঘোষণা করেন।
সুভাষচন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত ও কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা এবং বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়।এবং এই কারণে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি মনে করতেন সত্যাগ্রহের নেতা ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরে আঘাত ছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের স্বর্ণ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন । ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে এগারোবার কারারুদ্ধ করে। তার বিখ্যাত উক্তি তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘোষিত হওয়ার পরেও তার মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতাকে সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনা হয় তিনি ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে।
জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি কবে আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করে। জাপানের সহায়তায় তিনি নির্বাচিত আজাদ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ ব্রিটিশ মিত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ বর্তমানে মায়ানমার যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধে শক্তিগুলোর সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের কারণে কোন কোন ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন। তবে ভারতের অন্যান্যরা তার প্রচেষ্টাকে অর্থনৈতিক আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি হিসেবে নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তার পথপ্রদর্শক সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিকাংশ ও মর্যাদা বা স্ট্যাটাস এর পক্ষে মত দেন, সেখানে সুভাষচন্দ্র বসু প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন।
অন্যান্য যুবনেতা তারে মতামত সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিং এর ফাঁসি ও তার জীবন রক্ষায় নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্দ সুভাষচন্দ্র গান্ধী চুক্তি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
মহান এই ব্যক্তিত্ব চিরকাল ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। ভারত বর্ষ স্বাধীন হওয়ার পিছনে তার ভূমিকা সর্বাধিক। নিজের জীবন দিয়ে তিনি ভারতবর্ষকে স্বাধীন করেছেন এবং ব্রিটিশ ও ইংরেজ শাসনের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করেছেন।
পাকিস্তানি শাসন আমল
পাকিস্তানি শাসনামলে আমাদের দেশে অন্ধকার যুগ নামে পরিচিত।এই সময়ে বাংলার মানুষ অনেক রকম অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১ সালের এই সময়কে পাকিস্তানি শাসনামলে জানে। ভূমি সংস্কারের অধীনে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত জমিদার ব্যবস্থা করা হয়।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্বেও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল বর্তমানে বাংলা। পূর্বপাকিস্তানে ছিল বাঙালি জনগোষ্ঠীর এবং পশ্চিম পাকিস্তান ছিল পাকিস্তানিদের হাতে। পূর্ব পাকিস্তান ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের পূর্ব অংশ যা স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে বর্তমানে পরিচিত। ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয় যথা ভারত ও পাকিস্তান।মুসলিম আধিক্যের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করা হয় যার ফলে পাকিস্তানের মানচিত্রে দুটি পৃথক অঞ্চল অনিবার্য হয়ে ওঠে।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত হয় যার একটি পূর্ব পাকিস্তান এবং অপরটি পশ্চিম পাকিস্তান নামে পরিচিত। পূর্বপাকিস্তানে গঠিত হয়েছিল প্রধানত পূর্ববঙ্গ নিয়ে যা বর্তমানে বাংলাদেশ। ১৯৪৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়কে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানি শাসনামলে হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।
১৯৫০ সালের ভূমি সংস্কারের অধীনে ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত জমিদার ব্যবস্থা করা হয় কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত গুরুত্ব সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সংঘাতের প্রথম লক্ষণ হিসেবে প্রকাশ পায়। পরবর্তী দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে নানা পদক্ষেপের পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সবার মনে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ ছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা।
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তার ঠিক দশ বছর পর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয় এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান কে পরাজিত করার লক্ষ্য নিয়ে সম্মিলিত বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা ছিল পাকিস্তানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্বপাকিস্তানে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বমূলক আন্দোলনের মাইলফলক।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীকার প্রশ্ন ১৯৫০ এর মধ্যভাগ থেকে উচ্চারিত হতে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে অথবা সেনাবাহিনীর উঁচু পদে বাঙ্গালীদের নিয়োগ পাওয়া ছিল খুবই কঠিন।
সেইসাথে বিনিয়োগ অবহেলার কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের হয়ে উঠেছিল পশ্চিমের কলকারখানার কাঁচামালের যোগান দাতা এবং তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রধান ক্রেতা। কোন সন্দেহ নেই যে পাকিস্তান তৈরির পেছনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর চুক্তিতে সায় দিলেও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা কখনোই তাদের বাঙালি জাতিসত্তার এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের ভবিষ্যত নির্ধারণের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করেনি।
কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে এত দ্রুত কেন অস্থির হয়ে পড়ল বাঙালি? পাকিস্তানের সৃষ্টির দুই দশক না যেতেই বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে তাদের আবেগ আকাঙ্ক্ষার বাঁধ ভেঙে পড়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা যেহেতু দেশের পশ্চিমাংশের ঘাঁটি গানের শাসন ক্ষমতা ও সেখানেই কুক্ষিগত হয়ে পড়ে যদিও পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ।সেইসাথে শুরু হয় রাজনীতি অর্থনীতি সংস্কৃতি শিক্ষা প্রশাসন প্রতিরক্ষা শহর সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের অন্য একটি অংশের নাগরিকদের প্রতি পদে পদে বৈষম্য।
অর্থাৎ পাকিস্তান আমল পুরোটাই ছিল শোষণ ও নিপীড়নের। বাঙালির উপর পাকিস্তানিরা হাজারো অত্যাচার করেছে এই সময়ে। কেবলমাত্র বাঙালির অদম্য সাহস এবং ইচ্ছার কারণে এই শাসন বন্ধ হয় এবং অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলার।